ঈন্দ্রভুষণ বসু ও সত্যভুষণ বসুর উদ্যোগে বসুশ্রী সিনেমার পথচলা শুরু ১৯শে ডিসেম্বর ১৯৪৭ সালে। ঋত্বিক ঘটকের ‘অযান্ত্রিক’, সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’, ‘সোনার কেল্লা’র প্রিমিয়ারের আয়োজক বসুশ্রী। হিন্দী ছবির ক্ষেত্রে, বিমল রায় পরিচালিত ‘দেবদাস’ (১৯৫৫), নিতিন বসু’র ‘গঙ্গা-যমুনা’ (১৯৬১)’র প্রিমিয়ার হয়েছে এই ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হলে। বর্তমানে কি অবস্থা এই বর্ষীয়ান পেক্ষাগ্রহের?
৭৬ বছর বয়সী এই সিনেমা হলটি হাজরা মোড় ও যতীন দাস পার্ক মেট্রো স্টেশনের খুবই কাছে অবস্থিত। বসুশ্রীর নামকরণ প্রতিষ্ঠাতাদের পদবীর সাথে মিল রেখে। বসু পরিবারের সাথে সিনেমার যোগাযোগ বহুদূর বিস্তৃত। সত্যভুষণ বসু ও তার ভাই ফণিভুষণ বসু ‘ছন্দবাণী প্রাইভেট লিমিটেড’ নামের এক প্রযোজনা সংস্থা তৈরি করেছিলেন। বিধাণ সরণী তে অবস্থিত ‘বীণা’ সিনেমাও এনাদের প্রয়াসে নির্মিত। বসুশ্রীর উদ্বোধন এম এস শুভালক্ষ্মী অভিনীত ‘মীরা’ ছবি দিয়ে। এরপরে বসুশ্রীতে মুক্তি পায় উদয় শঙ্করের অভিনীত-পরিচালিত ‘কল্পনা’। সত্যভুষণ বসুর মৃত্যুর পরে, ওনার ছবি সমেত স্লাইড পর্দায় ভেসে উঠতো ছবি শুরুর আগে।
এই হলে, বিদেশি তিনটে প্রজেক্টরে ছবি দেখানো হতো। তার মধ্যে একটি, এখনো রাখা আছে সিনেমা হলের লবিতে। নানা ইতিহাসের সাক্ষী এই পেক্ষাগ্রহ। ‘অযান্ত্রিক’ ছবিতে ব্যবহৃত ‘জগদ্দল’ গাড়িটিকে, ছবির প্রিমিয়ারে ব্যালকনিতে তোলা হয়। দুলাল গুহ পরিচালিত, অমিতাভ বচ্চন, রেখা, প্রেম চোপড়া অভিনীত ‘দো আনজানে’ ছবির শুটিং হয়েছে বসুশ্রীতে।
তামিল ছবি দিয়ে বসুশ্রী যাত্রা শুরু করলেও, ৬০-৭০-৮০’র দশকে নানান হিন্দী ছবি মুক্তি পেয়েছে। ‘মুঘল-ই-আজম’ (১৯৬০), ‘জনি মেরা নাম’ (১৯৭০), ‘দিওয়ার’ (১৯৭৫), ‘মুকাদ্দার কা সিকান্দর’ (১৯৭৮), ‘লাওয়ারিশ’ (১৯৮১), প্রতিটি ছবিই কমপক্ষে ১০ সপ্তাহ ধরে চলেছে এই হলে। হিন্দী ছবির পাশাপাশি, ‘দেয়া নেয়া’ (১৯৬৩), ‘এন্টনী ফিরিঙ্গী’ (১৯৬৭), ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪), এবং ‘বাবা তারকনাথ’ (১৯৭৭) ভালো ব্যবসা করে।
বর্তমানে, ১০৩০ সীটার এই হলের টিকিট মূল্য ৯০ ও ১১০ টাকা। ডলবি ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম বসে ১৯৯৭ তে। এক দশক বাদে ২০০৭-এ আসে ডিজিটাল প্রজেকশন। ২০১৭ তে বসে ‘টু কে’ প্রজেকশন। তবে, আর পাচঁটা ‘সিঙ্গেল স্ক্রিন’ থিয়েটারের মতোই অবস্থা বসুশ্রীর। করোনা অতীমারির আগে ২০০ টাও টিকিট বিক্রি হতোনা প্রতি শো তে। সাম্প্রতিক সময়ে, পরাণ বন্দোপাধ্যায়-দেব অভিনীত ‘টনিক’ (২০২১), অনীক দত্ত পরিচালিত ‘অপরাজিত’ (২০২২), অভিজিৎ সেন পরিচালিত, মিঠুন চক্রবর্তী-মমতাশঙ্কর-দেব অভিনীত ‘প্রজাপতি’ (২০২২), শাহরুখ খান অভিনীত ‘পাঠান’ ভালো ব্যবসা করেছে। বর্তমানে, এবার পুজোয় রিলিজ করা প্রতিটা ছবিই চলেছে এই প্রাচীন হলে।
অতিমারির আবহে, ২০২০ তে বসুশ্রী বন্ধ থাকে ২০ শে নভেম্বর থেকে ক্রিস্টমাস অবধি। ২০২১ এর ২২ শে এপ্রিল বন্ধ হয়ে ১৯শে অগাস্ট ২০২১ তে হলের দরজা খোলে অক্ষয় কুমার অভিনীত ‘বেল বটম’ ছবি দিয়ে। কিন্তু ২০২৪ শে দাঁড়িয়ে এতটাই দূরাবস্থা, যে ঐতিহাসিক সেই তিন প্রজেক্টর কে বিক্রি করা হতে পারে। হল বিক্রীর বিষয়ে, বসুশ্রী পরিচালনা সমিতির নানানজনের নানা মত। অংশীদারদের মধ্যে একজন, সৌরভ বসু নানান অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র উৎসবের মাধ্যমে বসুশ্রীকে সচল রাখার চেষ্টা করেছেন। তবে, পরিচালনা সমিতির একাংশ চান হল পরিচালনা করুক অন্য কোনো পক্ষ, তারা মাসিক ভিত্তিতে টাকা নেবেন।